ভারতের এক আধুনিক শহর গুরগাঁও। নয়া দিল্লির কাছেই এই শহরটি। এই শহরে যেমন দেখা যায় আকাশচুম্বী বহু ভবন তেমনি রয়েছে ঝুপড়িঘরের বস্তিও। ত্রিপলে ঢাকা এই ঘরগুলোর আশেপাশে আবর্জনার পাহাড় আর মশার আস্তানা। যেন অমরাপুরীর সামনেই এক বিধ্বস্ত নগরী। উঁচু উঁচু অট্টালিকার ঘরগুলো সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা গৃহপরিচারিকা, ময়লা সংগ্রহকারী, দিনমজুরদের বাস এই বস্তিতে। তবে এই অমরাপুরী ও বস্তিপুরীর যে প্রয়োজনে মেলবন্ধন তাতে আঘাত হেনেছে ভারতে চলমান অবৈধ অভিবাসী আটক অভিযান। দুই পাড়ের বাসিন্দাদের মধ্যে জন্ম দিয়েছে আতঙ্কের-অসহায়ত্বের।
গত মাসে ঝুপড়ির বাসিন্দাদের মধ্যে প্রায় কয়েকশ মানুষকে অবৈধ অভিবাসী সন্দেহে ‘যাচাই-বাছাই’-এর নামে আটক করে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। তাঁদের অধিকাংশের দাবি, তাঁরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি ভাষাভাষী মুসলিম।
সন্দেহভাজনদের অভিবাসী আটক কেন্দ্রে নিয়ে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য দলিলপত্র দেখাতে বলা হয়। এ সময় পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলেও অনেকে অভিযোগ করেন। যদিও পুলিশ এই অভিযোগ অস্বীকার করে।
১৫ বছর ধরে গুরগাঁওয়ের এই বস্তিতে থেকে কাজ করেন দিনমজুর আথের আলী শেখ। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে ভোটার আইডি ও জাতীয় পরিচয়পত্র ছিল, কিন্তু তারা বললো এগুলো নকল। ছয় দিন আমাকে আটকে রাখল। তারপর মুক্তি পেলাম।’
আথের আলীর স্ত্রী অগোছালো জামাকাপড়, বাসনপত্র সবকিছু বাক্সবন্দী করছিলেন। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে আথের আলী বলতে থাকেন, ‘আমি এখনো বুঝতে পারছি না, আমাকে কেন ধরে নিয়ে গেল।’
কণ্ঠে রাগ নিয়ে তিনি প্রশ্ন করে বসলেন, ‘আমার ভাষার কারণে? আমার ধর্মের কারণে? নাকি আমার দরিদ্রতার জন্য? আর যদি তেমন না হয় তাহলে ধনী বাঙালি বাসিন্দাদের কেন আটকানো হলো না?’
তবে গুরগাঁও পুলিশের দাবি, কোনো বিশেষ সম্প্রদায়কে টার্গেট করা হয়নি। বিবিসিকে পুলিশ কর্মকর্তা সন্দীপ কুমার বলছিলেন, ‘ধর্ম কিংবা সামাজিক অবস্থানের কোনো প্রভাব এই অভিযানে নেই।’
তিনি আরও জানান, গ্রেপ্তার ২৫০ জনের মধ্যে মাত্র ১০ জনকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে। বাকি সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আটক কেন্দ্রগুলোতে কাউকে কোনো রকম অমানবিক আচরণ করা হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।
গত কয়েক মাসে শত শত মানুষকে অবৈধ অভিবাসী সন্দেহে আটক করা হয়েছে। যাদের মধ্যে একজন ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রবীণ মুসলিম অফিসারও রয়েছেন।
বিশেষ করে উত্তর-পূর্বের রাজ্য আসামে দীর্ঘদিন ধরেই শত শত বাঙালি মুসলিমকে ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে বাংলাদেশে পুশ ইন করা হচ্ছে। দিল্লিতেও অবৈধ অভিবাসী পাকড়াও অভিযান চলছে। গত ছয় মাসে প্রায় ৭০০ জনকে আটক করা হয়েছে।
এরই অংশ হিসেবে গুরগাঁওয়ের কলোনিতে এই অভিযান। কলোনিটিতে যেন এক ঝড় বয়ে গেছে। এই অভিযান আতঙ্কে শহর ছেড়েছেন অনেক বাসিন্দা। ঘর-কর্মক্ষেত্র এমনকি পরিবার ফেলেও চলে গেছেন অনেকে।
কলোনির বাসিন্দা রাউনা বিবি গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। তিনি বলতে থাকেন, ‘বছরের পর বছর আমরা তাদের আবর্জনা পরিষ্কার করতাম। আর এখন আমাদেরই আবর্জনার মতো ছুড়ে ফেলা হচ্ছে।’
রাউনার স্বামী এই আটক অভিযান শুরুর দিন পশ্চিমবঙ্গ থেকে ফিরেছিলেন। অভিযান দেখে আবার পালিয়ে যান স্ত্রীকে না জানিয়েই। রাউনা বলেন, ‘তিন দিন ধরে ভাবছিলাম হয়তো তাঁকে ধরে নিয়ে গেছে। সে বেঁচে আছে কিনা সেটাও ভাবছিলাম। শেষে ফোন এলো। বললো সে ফোন করেনি কারণ কোনো ঝামেলা চায়নি।’
স্বামীর আচরণ বা বেকারত্ব এসব কিছুই রাউনার মনকে এতটা নাড়া দেয়নি। তাঁকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে তাঁর আত্মসম্মান কেড়ে নেওয়া। নিজের মতো করে বাঁচার স্বস্তি হারানো। নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ হচ্ছিল তাঁর।
রাউনা বলতে থাকে, ‘দারিদ্র্যের সঙ্গে আমি লড়তে পারি। কঠোর পরিশ্রম করতে পারি। কিন্তু এটা… যদি ওরা আমাদের ধরে নিয়ে যায়, আমি জানি না কীভাবে বাঁচব। এই বস্তি, আমরা যে কাজ করি, যে বাড়িগুলো পরিষ্কার করি, এটাই আমাদের জীবন।’
Manual7 Ad Code
পুলিশ কর্মকর্তা সন্দীপ কুমার জানান, গত মে মাসে অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ এসেছিল। সেই নোটিশের প্রেক্ষিতে এ অভিযান চালানো হয়।
নোটিশে সব রাজ্যকে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠনের এবং ‘বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে আসা অবৈধ অভিবাসীদের শনাক্ত, চিহ্নিত ও ফেরত পাঠানোর’ জন্য হোল্ডিং সেন্টার তৈরি করতে বলা হয়।
আটকদের ৩০ দিনের মধ্যে নাগরিকত্ব প্রমাণ করে নথি যাচাইয়ের জন্য নিজ নিজ জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠাতে বলা হয়। যদি যাচাইয়ের পর তথ্য প্রমাণিত না হয়, তবে সন্দেহভাজনদের পুলিশ ‘যথাযথ পাহারায়, যতটা সম্ভব দলবদ্ধভাবে’ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করবে, যাতে তাদের ফেরত পাঠানো যায়।
তবে কীভাবে এক ব্যক্তিকে এই সন্দেহভাজনের তালিকায় যুক্ত করা হবে তা এই নির্দেশে বলা হয়নি। এ নিয়ে সমালোচনার জন্ম হয়। শ্রমিক অধিকার রক্ষায় নিয়োজিত অল ইন্ডিয়া সেন্ট্রাল কাউন্সিল অব ট্রেড ইউনিয়নসের জাতীয় পরিষদের সদস্য আকাশ ভট্টাচার্য বলেন, ‘উপরে উপরেই দেখলে বিষয়টা আর কিছু নয়, তুমি বাংলা ভাষায় কথা বলো, মুসলিম নাম আছে আর বস্তিতে থাকো, এই কারণেই তুমি সন্দেহভাজন।
আকাশ ভট্টাচার্য অভিযোগ করে বলেন, আরও খারাপ ব্যাপার হচ্ছে, যাদের নাগরিকত্ব আগে যাচাই হয়ে গেছে, তাদের কাউকেই সেই বিষয়ে প্রমাণপত্র দেওয়া হচ্ছে না। এর মানে হলো, তাদের আবারও সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হতে পারে এবং আবারও এই প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা তাদের ভীষণ অসহায় করে তোলে।
পুলিশ কর্মকর্তা সন্দীপ কুমার বলেন, গুরগাঁওয়ে যাদের আটক করা হয়, তাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রাথমিক প্রমাণ ছিল। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তাদের ফোন পরীক্ষা করে বাংলাদেশ থেকে আসা সন্দেহজনক যোগাযোগ পেয়েছি। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাদের মধ্যে কয়েকজন নিজের বংশপরিচয় সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারেনি।’
এই সন্দেহের পদ্ধতি নিয়ে মানবাধিকার কর্মী সুহাস চাকমা বলেন, এই নীতি অবশ্যই ধর্মভিত্তিক নয়। তবে মুসলিমদের গ্রেপ্তারের ঘটনা বেশি মনে হতে পারে, কারণ বাংলাদেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষই মুসলিম।
তিনি আরও বলেন, দশকের পর দশক ধরে শরণার্থীদের ঢল দেখা ভারতের উচিত এই জটিল সমস্যাগুলো সমাধানে একটি বিস্তৃত শরণার্থী আইন তৈরি করা।
তবে এখন দেশটির বাংলা ভাষাভাষী মুসলিমরা গভীর উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকে বালিশের নিচে কাগজপত্র রেখে ঘুমাচ্ছেন, যাতে ধরপাকড় এড়ানো যায়।
দিল্লির অভিজাত এলাকাগুলোর এক কোণে অবস্থিত বিশাল বস্তি ‘জয় হিন্দ ক্যাম্প’-এর বাসিন্দা রবিউল হাসান বলেন, ‘আমরা তো আগেই জীবনের কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করছিলাম। এখন আমাদের এটা নিয়েও লড়তে হবে।’
Manual3 Ad Code
এই অভিবাসী আটক অভিযানের মধ্যেই তিন সপ্তাহ আগে ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেয় কর্তৃপক্ষ। প্রায় ৪০০ মানুষ অন্ধকারে ডুবে যায়।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ওই বস্তিতে বসবাস করে আসছেন তাঁরা। এর মধ্যে এই স্থানে অবৈধভাবে ব্যক্তিগত জমিতে দখল করে আছেন এমন দাবিতে আদালতের এক রায়ের পর এই পদক্ষেপ নেয় কর্তৃপক্ষ। আদালতের এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিলকারী আইনজীবী অভীক চিমনি বলেন, ‘শহরের নিজস্ব নগর পরিকল্পনা সংস্থা এই এলাকাকে বৈধ বস্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও তারা এই কাজ করেছে।’
এই আটক অভিযানের প্রভাব পড়েছে গৃহকর্মী রাউনা বিবির ঘরেও। ছবি: বিবিসি
বিদ্যুৎবিহীন বস্তিতে বাসিন্দারা যেন বিহ্বল, ক্ষুব্ধ আর ক্লান্ত অবস্থায় বেঁচে আছেন। বস্তির বাসিন্দা বাইজান বিবি বলেন, ‘এত গরম। খাবার পচে যাচ্ছে। বাচ্চারা কানতে থাকে। গরমের চোটে রাতে বাইরে ঘুমাতে যাই। কিন্তু সেখানেও মশা আর মশা।
Manual7 Ad Code
তিনি আরও বলে, ‘আর পারি না। মাঝে মাঝে ভাবি, এর চেয়ে আটক করে নিয়ে গেলেও ভালো ছিল। আটক কেন্দ্রে অন্তত একটা ফ্যান তো থাকবে।’
Manual8 Ad Code
এসব অভিযানের প্রভাব সমাজের উপরতলায়ও ফেলেছে গভীর প্রভাব। বস্তি পাড়ায় এই আটক অভিযানের কারণে উদ্বেগে আছেন শহরের অট্টালিকার বাসিন্দারা। এই আতঙ্কের কারণ ওই বস্তির মানুষের ওপর নির্ভরশীল ছিল তাদের দৈনন্দিন জীবন।
আটক হওয়ার আতঙ্কে অনেক কর্মী, পরিচারিকা ও দিনমজুরেরা শহর ছেড়ে গিয়েছেন। যে কারণে অ্যাপার্টমেন্ট এলাকাগুলোর সড়কে আবর্জনার স্তূপ জমতে শুরু করেছে। গৃহকর্মীদের ছাড়া সব কাজ সামলাতে নাভিশ্বাস উঠছে গৃহকর্ত্রীদের। এমনকি কোনো সারাই কাজের জন্য যেসব দিনমজুরদের পাওয়া যেত তারাও ছেড়েছেন শহর।
স্থানীয় এক অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের বাসিন্দা তাবাসসুম বানু বলেন, ‘আমাদের গৃহকর্মী এবং তাঁর স্বামী আমাদের গাড়িচালক দুজনেই চলে গেছেন। এখন আমাদের সাহায্য করার কেউ নেই। খুবই অসহায় অবস্থায় পড়ে গেছি আমরা।’