ট্রাফিক বিভাগের ঘুষ বাণিজ্যে, কতৃপক্ষের কোন ব্যবস্থা গ্রহণের খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি

প্রকাশিত: ৯:৪১ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৫

ট্রাফিক বিভাগের ঘুষ বাণিজ্যে, কতৃপক্ষের কোন ব্যবস্থা গ্রহণের খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি

এসএমপির ট্রাফিক বিভাগের ঘুষ বাণিজ্যে, উর্দ্ধতন কতৃপক্ষের কোন ব্যবস্থা গ্রহণের খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

দীর্ঘদিন ১৭ বছর সারাদেশের পুলিশ বাহিনী ছিলো একটি দুষ্ট চক্রের ভিতরে শিকল বন্ধি। হাসিনা সরকারের পতন ও ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে অন্তবর্তীকালিন সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেক দূর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তা শ্রীঘরে আছেন। অনেকে প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।

 

 

 

 

 

আবার অনেকে হত্যাসহ বিভিন্ন মামলার আসামী হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, রয়েছেন আত্মগোপনে।৫ আগষ্টে দায়িত্বে থাকা সাবেক কমিশনার জাকির হোসেন খানকে ঢাকায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের উপ-মহাপরিদর্শক হিসেবে সংযুক্ত করা হয়েছে অনেক আগেই। গত ৫ আগষ্টের পর এসএমপিতে নতুন কমিশনার হিসাবে যোগদেন মোঃ রেজাউল করিম (পিপিএম-সেবা)।

 

 

 

 

 

সারাদেশের মতো সিলেট এসএমপি পুলিশ বাহিনীতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।

বিশেষ করে এসএমপির ট্রাফিক পুলিশে গত ৬ মাসের মধ্যে তিনজন ডিসিকে রদবদল করা হয়েছে। বর্তমানে উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) অতিরিক্ত দায়িত্বে উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান ট্রাফিক বিভাগের ডিসি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে ছিলেন বর্তমান ডিবির ডিসি আশরাফ উল্যাহ তাহের।

 

 

 

 

তিনি ট্রাফিক বিভাগে দায়িত্ব নেওয়ার পর কমিশনারকে নিয়ে মাঠে নামেন অভিযানে। চাঞ্চল্য ফিরে ট্রাফিক পুলিশের মাঝে। নগরীর অনেক অবৈধ স্টেন্ডের বিরুদ্ধে শুরু হয় অভিযান। পরে তাকে সরিয়ে সেখানে দায়িত্ব দেওয়া হয় দক্ষিণের ডিসি মাহফুজুর রহমানকে।

 

 

 

 

যদিও এসএমপি কমিশনার একাধিক ডিসিকে রদবদল করার পাশাপাশি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এসএমপি পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে। কিন্তু এতো কিছুর পর পরির্বতন হয়নি এসএমপির ট্রাফিক বিভাগের ঘুষ বাণিজ্যের। গত কয়েকদিন থেকে এমনটি আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে সোস্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে। তবে এ নিয়ে উর্দ্ধতন কতৃপক্ষের কোন ব্যবস্থা গ্রহণের খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

 

 

 

 

এদিকে ট্রাফিক বিভাগ নিয়ে কয়েকদিন অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, গত ৫ আগষ্টের পর থেকে শুধু ঘুষ বাণিজ্যের লাইনম্যান বদল হয়েছে। তবে বেড়েছে ঘুষের টাকার পরিমান, ও অবৈধ গাড়ির স্ট্রেন্ডের পরিমান। সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে নির্ভয়ে এসএমপির ট্রাফিক বিভাগে চলছে লাগামহীন চাঁদাবাজি চলছে।

 

 

 

 

সূত্র বলছে, ট্রাফিক পুলিশের সাতজন কর্মকর্তা যারা দরবেশ হিসাবে পরিচিত তারা নিজেরাই এলাকা ভাগ করে নিয়েছেন, যা থেকে মাসিক ঘুষের ইনকাম প্রায় অর্ধকোটি টাকা। সেই দলে আছেন প্রকাশ নামের একজন সার্জেন্ট আর সাত জন টিআই। তবে সকলকে ছাড়িয়ে গেছেন সার্জেন্ট প্রকাশ।

 

 

 

এসএমপির ৬টি থানার ১৭ টি স্থানে সরকারি কাজের জন্য প্রতিদিন ৫টি নোহা/মাইক্রোবাস, ১০টি সিএনজি অটোরিকশা ও ৫টি লেগুনা রিকুইজিশন করা হয়।এই দায়িত্ব পালন করে সার্জেন্ট প্রকাশ। এ কয়টি গাড়ির বিপরীতে সার্জেন্ট প্রকাশ প্রায় শতাধিক গাড়ি আটক করেন। রিকুইজিশনের নামে চলে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি।

 

 

 

 

ফিটনেসবিহীন প্রতি যানবাহনকে ৭০০ টাকার বিনিময়ে দেয়া হয় রিকুইজিশন স্লিপ। সেই স্লিপ দেখিয়ে চালকরা স্বাধীন ভাবে চলাচল করতে পারেন। স্লিপযুক্ত যানবাহনে করে মাদক, ভারতীয় পণ্যসহ অবৈধ মালামাল পরিবহন হচ্ছে বলে একটি সংস্থা নিশ্চিত করেছে। রিকুইজিশন চাঁদাবাজি থেকে প্রকাশের দিনে আয় ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকা।

 

 

 

 

মাসে আয়ের পরিমান দাঁড়ায় প্রায় ১৮ থেকে ২৫ লক্ষ টাকা। সেখান থেকে ভাগ পান ট্রাফিক অফিসে প্রশাসন শাখায় কর্মরত টিআই শফিক, প্রসিকিউশন শাখায় কর্মরত টিআই সুহেল সহ ঊর্ধ্বতন কয়েকজন।

 

আর্ও পডুন– ৭ ট্রাফিকপুলিশের অনৈতিক আয় অর্ধকোটি টাকা

সার্জেন্ট থেকে থেমন একটা পিছিয়ে নেই টিআই মোশাররফ হোসেন। সিলেট শহরের প্রবেশদ্বার দক্ষিণ সুরমার হুমায়ুন রশিদ চত্বরে মোশারফের ফেলে রাখা জালে আটকা পড়ছেন সুবিধাভোগীরা। পণ্যবাহী যানবাহন শহরে প্রবেশে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে নির্ধারিত চাঁদা দিয়ে হুমায়ুন রশিদ চত্বর হয়ে নগরীতে ঢুকছে। চত্বর দিয়ে চালিবন্দর পৌঁছলে ট্রাক প্রতি দিতে হয় ৮০০ টাকা, বুরহান উদ্দিন রোডে যাতায়াত করলে ৫০০ টাকা করে নেন মোশাররফ। দিনে ১৫ থেকে ২০টি ট্রাক নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে প্রবেশ করে পণ্য লোড আনলোড করছে।

 

 

 

 

ট্রাক ছাঁড়াও তার সাথে চুক্তির আওতাধীন রয়েছে অনুমোদনহীন শতাধিক টমটম। কদমতলীর বান্দের নিচে চলা টমটম থেকে ও হানিফের মাধ্যমে প্রতিদিন ১ হাজার টাকা আদায় করেন লাইনম্যান শাহাদাত। ফেঞ্চুগঞ্জ রোডে চলাচলকারী লেগুনা থেকে মাসে ২০ হাজার। বাস-ট্রাক গাড়ী থেকে নেন মাসে আরো ২০ হাজার টাকা।

 

 

 

 

সব মিলিয় মোশাররফের মাসিক আয় ৪ থেকে ৫ লক্ষ টাকা। টিআই আজাদ হোসেন খাঁনের বর্তমান দায়িত্বাধীন এলাকা বন্দরবাজার কোর্ট পয়েন্ট হলেও তিনি পূর্বে দায়িত্বে থাকা কদমতলী মুক্তিযোদ্ধা চত্বর এলাকার ফুটপাত থেকে নিয়মিত মাসোহারা নিচ্ছেন।

টিআই মোহাম্মদ নুরে আলমের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকা দক্ষিণ সুরমা।

 

 

 

সিলেটে সবচেয়ে বেশি অনটেশ ও ডাবল নাম্বার প্লেটের সিএনজি চলাচল করে এই রোডে। সিএনজি শ্রমিকনেতা আলতাফ ও ওয়ারিসের মাধ্যমে চলা অনটেশ সিএনজি থেকে তিনি ২০ হাজার টাকা মাসোহারা পান। এছাড়াও ক্বিনব্রীজের মুখের বাসস্ট্যান্ড ও তিনটি সিএনজি স্ট্যান্ড এবং টমটম স্ট্যান্ড ছাঁড়াও বাবনা পয়েন্ট, রেলগেইট পয়েন্ট, মার্কাজ পয়েন্ট, কাজিরবাজার দক্ষিণ প্রান্ত, জিঞ্জির শাহ এলাকা ও চন্ডিপুল পয়েন্টের সিএনজি স্ট্যান্ডের সাথেও তার মাসিক চুক্তি রয়েছে। টিআই শফিক পূর্বে দীর্ঘদিন সার্জেন্ট হিসেবে এসএমপিতে চাকরি করেন। বর্তমানে টিআই হয়ে আবার এসএমপিতে যোগদান করে অদৃশ্য শক্তিবলে দক্ষ টিআইদের পেছনে ফেলে ট্রাফিক অফিসের টিআই প্রশাসনের চেয়ার দখল করে নিয়েছেন।

 

 

 

 

সড়কে ইনকামের ভালো ধারণা থাকায় মাঠে থাকা অফিসাররা তাকে বড় অংকের ভাগ দিতে হয় বলে কয়েকজন অফিসার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান। তবে ভাগ থেকে নিরাশ হন না প্রসিকিউশন শাখার টিআই সুহেলও। পাশাপাশি সোহেল বিভিন্ন যানবাহনের ত্রুটিপূর্ণ কাগজপত্র আটক রেখে মালিক পক্ষের কাছ থেকে ঘুষের বিভিন্ন পরিমানে টাকা আদায় করার অভিযোগ রয়েছে। তার মাসে আয় ১ থেকে দেড় লক্ষ টাকা।

 

 

 

গত ২৭ জানুয়ারি বিকেলে টিআই শফিক, সোহেল ও মোশাররফকে এক সাথে হুমায়ুন রশিদ চত্বর এলাকায় দীর্ঘ সময় অবস্থান করতে দেখা যায়। তাদের লাইনম্যান শফিকুল ইসলাম শামীম, তিনি শিববাড়ী থেকে কদমতলী পর্যন্ত টমটমের লাইন থেকে টাকা উত্তোলন করেন।লাইনম্যান শফিকুল ইসলাম শামীমের বিশেষ কার্ড দিয়ে শিববাড়ী থেকে কদমতলী ও আলমপুর থেকে পুলের মুখ পর্যন্ত চলাচল করে টমটম।গাড়ি ধরার পর গাড়ি চালক সেই কার্ড দেখালেই ছেড়ে দেওয়া হতো টমটম । শফিকুল ইসলাম শামীম জাতীয় অটোবাইক শ্রমিকলীগ সিলেট জেলার সভাপতি ছিলেন ।

 

কোতোয়ালী থানার সামন থেকে কানিশাইল চলাচলকারী টমটম থেকে তিনি টমটম ম্যানেজার জনি ও জুমনের মাধ্যমে প্রতিমাসে ৩০ হাজার টাকা নেন। কোতোয়ালী থানার ওসির নাম বলে ওসির ডাইভার ও বডিগার্ড দুজনে নেন মাসে আরো ৩০ হাজার টাকা। সিসিকের সামনের সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে প্রতিমাসে মাসে ৫ হাজার, মধুবন মার্কেটের সামনের সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে লাইনম্যান রুবেলের মাধ্যমে ৫ হাজার ও কালেক্টর মসজিদের সামনের লেগুনা স্ট্যান্ড থেকে লাইনম্যান শফিকের মাধ্যমে ৫ হাজার।

 

 

 

 

 

 

এছাড়াও সেখানের সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে ৫ হাজার, জিতু মিয়ার পয়েন্টে অবস্থিত সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে লাইনম্যান কামরুলের মাধ্যমে মাসে ৩ হাজার, জেল রোর্ডের মুখের লেগুনা স্ট্যান্ড থেকে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা নেন টিআই আজাদ। বন্দর, জিন্দাবাজার ও জেলা পরিষদ এলাকার ফুটপাতও তার চুক্তির আওতাধীন রয়েছে।

সিলেটের পাইকারি বাজার কালিঘাটে সকাল ৮টার পর যে সমস্ত ট্রাক অবস্থান করে সেসব ট্রাক চালকরা ট্রাক প্রতি ২শত টাকা করে টিআই আজাদকে দিতে হয়। পূর্বে তিনি হুমায়ুন চত্বরে দায়িত্বপালন করায় সেখানে তার সাথে চুক্তিকৃত অনটেশ সিএনজি ও ফুটপাতের কিছু দোকান থেকে এখনও মাসোয়ারা আদায় করছেন। তার মাসে ঘুষ থেকে আয় আড়াই থেকে সাড়ে ৩ লক্ষ টাকা। সম্প্রতি র‌্যাবে বদলি হওয়া টিআই রুহুল আমিন আম্বরখানা পলাশ হোটেলের সামন থেকে এয়ারপোর্ট রোডে চলাচলকারী টমটম থেকে লাইনম্যান আনোয়ারের মাধ্যমে মাসে নিতেন ৫০ হাজার টাকা।

 

 

 

 

 

 

আম্বরখানায় নগরীর একমাত্র বৈধ স্ট্যান্ডে ১০টি সিএনজি অটোরিকশা অবস্থানের অনুমোদন থাকলেও শতাধিক সিএনজি স্ট্যান্ডে রয়েছে। সেখানের তিনটি সিএনজি স্ট্যান্ড মাসিক চুক্তিতে চলছে। তাছাড়া রুহুল আমিনের আওতাধীন এলাকায় চলাচলকারী অনটেশ সিএনজি থেকে মাসে ২০ হাজার টাকা, আম্বরখানা বড়বাজারের মুখ থেকে খাসদবির রোডে চলাচলকারী ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা আটক করে দিনে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা আয় করতেন।

 

 

 

 

যে সব রিকশা চালক চাহিদার ৫শত টাকা দিতে ব্যর্থ হলে তার রিকশা রেকার হতো। যার ফলে রুহুল আমিনকে আম্বরখানা থেকে নাইওরপুল ও শিবগঞ্জে বদলি করা হয়। সেখানে গিয়েও টিলাগড় পয়েন্ট থেকে বিভিন্ন সড়কে চলাচলকারী টমটম, লেগুনা ও সিএনজি শ্রমিকদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে আদায় করছেন মাসোয়ারা। তিনি র‌্যাবে বদলি হওয়ার পূর্বে প্রতি মাসে লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিতেন।

এভাবে ভাগে বিভক্ত এসএমপির ট্রাফিক শাখা ফলে কোন ভাবে এসএমপি এলাকার অবৈধ যান চলাচল বন্ধ করতে পারছেন না পুলিশ প্রশাসন। এদিকে এসএমপি বিভিন্ন এলাকায় যানঝট নিরশনে প্রায়ই কমিশনার নিজে বসছেন বিভিন্ন গাড়ির শ্রমিক, মালিক সংগঠনের জন্য। অপরদিকে নগরী থেকে অবৈধ যানবাহন অপসারণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে একাধিকবার সিলেট বিআরটি অফিস ঘেরাও করেন বৈধ পরিবহন শ্রমিকরা।

 

 

গত ৫ আগষ্টে ছাত্র জনতার আন্দোলনের ফলে ক্ষতি গ্রস্থ হয় পুলিশের অনেক স্থাপনা। নিহত হন অনেক পুলিশ সদস্য। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর নাজুক পুলিশ বাহিনীকে ঢেলে সাজানোর উদ্দ্যেগ গ্রহণ করেছে।

সুত্র: রাইজিং সিলেট।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বশেষ নিউজ