ধর্ম না পাল্টালেও শিয়া ইসলামের মহররম মাসে আশুরা পালন করে চলেছেন আজও

প্রকাশিত: ১০:০০ অপরাহ্ণ, জুলাই ৪, ২০২৫

ধর্ম না পাল্টালেও শিয়া ইসলামের মহররম মাসে আশুরা পালন করে চলেছেন আজও

ইতিহাসে অপরিসীম গুরুত্ব কারবালা যুদ্ধের।

জনশ্রুতি আছে, ৬৮০ খ্রীষ্টাব্দ বা হিজরি ৬১ সনের সেই যুদ্ধে নবীজী মোহাম্মদ (সা.) এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসাইনের হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন ভারতের এক হিন্দু সারস্বত ব্রাহ্মণ, যার নাম রিহাব সিধ দত্ত। শুধু নিজে যুদ্ধ করেছেন, তাই নয়; তার সাত পুত্রও নাকি ইউফ্রেটিস নদীর তীরে সেই যুদ্ধে জীবন দিয়েছিলেন।

 

 

 

 

রিহাব সিধ দত্তের সেই ‘উত্তরসূরীরা’ আজ শত শত বছর পরেও ইমাম হোসাইনের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা বজায় রেখেছেন, যে কারণে তারা নিজেদের ধর্ম না পাল্টালেও শিয়া ইসলামের অনেক রীতিনীতি, বিশেষ করে মহররম মাসে আশুরা পালন করে চলেছেন আজও।

 

 

 

প্রায় ১৪০ বছর আগে লেখা ‘বিষাদ সিন্ধু’ উপন্যাসে কারবালার যুদ্ধকে বাংলা সাহিত্যেও অমর করে গেছেন মীর মশাররফ হোসেন। ইতিহাস আর কল্পনা মেশানো সেই কাহিনীতে রিহাব সিধ দত্তের উল্লেখ না থাকলেও ভারতীয় উপমহাদেশে আজও বহু মানুষ আছেন যারা সেই বিবরণে সম্পূর্ণ আস্থা রাখেন এবং নিজেদের সেই ব্রাহ্মণ বীরের বংশধর বলেই পরিচয় দেন।

 

 

 

 

ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের মধ্যে এক বিরল সেতুবন্ধ রচনার কারণেই ভারতের সমাজজীবনে একটি অসাধারণ জায়গা অধিকার করে আছেন ‘হুসাইনি ব্রাহ্মণরা’। সংখ্যায় তারা কম হতে পারেন, কিন্তু স্বকীয়তায় ও ধর্মীয় সম্প্রীতিতে এক উজ্জ্বল জনগোষ্ঠী!

ইমাম হোসাইনের অনুগত, অথচ ধর্মবিশ্বাসে হিন্দু ব্রাহ্মণ; এই অনন্য সম্প্রদায় ‘হুসাইনি ব্রাহ্মণ’ নামে পরিচিত। ভারতের কোনো কোনো জায়গায় ‘মোহিয়াল ব্রাহ্মণ’ নামেও ডাকা হয় তাদের।

পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ, ভারতের পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, কাশ্মীর, দিল্লি ও লখনৌর নানা প্রান্তে এখনো বেশ কয়েক হাজার ‘হুসাইনি ব্রাহ্মণ’ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করেন। কোনো কোনো গবেষক জানাচ্ছেন, আরব উপদ্বীপেও অস্তিত্ব আছে হুসাইনি ব্রাহ্মণদের।

কারবালার যুদ্ধে রিহাব সিং দত্ত ও তার পুত্রদের বীরত্বকে স্মরণ করে প্রাচীন হিন্দুস্তানি কবি লিখে গেছেন –

সেই পরম্পরা অনুসরণ করেই আজও ভারতে হুসাইনি ব্রাহ্মণরা তাদের জীবনচর্যায় হিন্দু ও মুসলিম – দুই ধর্মেরই কিছু কিছু রীতি রেওয়াজ, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালন করে থাকেন।

‘ওয়াহ্ দত সুলতান/হিন্দু কা ধরম/মুসলমান কা ইমান/আধা হিন্দু, আধা মুসলমান!

আগামী ৬ জুলাই সেই ধারাবাহিকতায় এ বছরের আশুরা পালনে মহররমের তাজিয়া মিছিলেও যোগ দেবেন এই ‘হুসাইনি ব্রাহ্মণদের’ অনেকেই।

ভারতের প্রয়াত বলিউড অভিনেতা সুনীল দত্ত ছিলেন একজন হুসাইনি ব্রাহ্মণ। তার অভিনেত্রী স্ত্রী নার্গিস দত্তও ছিলেন ‘আধা-মোহিয়াল’। তাদের সন্তানরা, তারকা অভিনেতা সঞ্জয় দত্ত ও রাজনীতিবিদ প্রিয়া দত্তও পারিবারিক সূত্রে একই সম্প্রদায়ভুক্ত।

এছাড়াও হিন্দি-উর্দু ভাষার সাহিত্যিক সাবির দত্ত, আইনজীবী ও অ্যাক্টিভিস্ট নেত্রপ্রকাশ ভোগ, সুপরিচিত সাংবাদিক বারখা দত্ত, ধ্রুপদী সঙ্গীতশিল্পী সুনীতা ঝিংরান – ভারতের হুসেইনি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মধ্যে এরকম বহু ‘সেলেব্রিটি’ আছেন যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত।

‘মোহিয়াল’রা হিন্দু ব্রাহ্মণদের মধ্যে যোদ্ধার জাত হিসেবে পরিচিত ছিলেন; আজও তাদের বংশধরেরা অনেকে আর্মিতে যোগ দিয়ে থাকেন। ফলে, আজও ভারতীয় সেনাবাহিনীতে অনেক হুসাইনি ব্রাহ্মণ আছেন।

কিন্তু প্রশ্ন হল, ইমাম হোসাইনের হয়ে তাদের পূর্বসূরীরা যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন কেন? এ ব্যাপারে গবেষক ও ইতিহাসবিদরাই বা কী বলছেন? আর আজ এত বছর বাদেও হুসেইনি ব্রাহ্মণরা কীভাবে ধরে রেখেছেন তাদের অতি গর্বের একটি ইসলামী পরম্পরা?

ইউফ্রেটিস (ফোরাত) নদীর জল আটকে দিয়ে ইয়াজিদের সেনারা ততক্ষণে ইমাম হোসাইন ও তার সঙ্গীদের মৃত্যুর পথ তৈরি করে ফেলেছেন।

এদিকে রাজা সমুদ্রগুপ্ত তার বীর সৈন্যদের একটি দলকে কারবালায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন, যার নেতৃত্বে ছিলেন বীর যোদ্ধা রিহাব সিধ দত্ত– যিনি পাঞ্জাবের একজন মোহিয়াল ব্রাহ্মণ।

ইন্দো-ইসলামিক স্কলার গুলাম রসুল দেহলভির মতে, হুসাইনি ব্রাহ্মণরা হলেন প্রাচীন ভারত ও ইসলামী বিশ্বের মধ্যে সম্পর্কের এক অতুলনীয় নিদর্শন।

দেহলভি বিবিসিকে বলছিলেন, স্বৈরাচারী ইয়াজিদ যখন ইমাম হোসাইনকে কারবালার প্রান্তরে সপরিবারে মেরে ফেলার চক্রান্ত করলেন, তখন তিনি বিশ্ব মানবতার উদ্দেশে আহ্বান জানিয়েছিলেন ‘হাল মিন নাসিরিন ইয়ানসুরনা!’ – যার অর্থ ‘কেউ কি কোথাও আছে, যারা আমাদের সাহায্য করতে পারে?’ সেই ডাকে সাড়া দিলেন সুদূর ভারতের (হিন্দুস্তান) রাজা সমুদ্রগুপ্ত, যিনি ইমাম হোসাইনের পুত্র আলি আকবরের কাছ থেকেও সাহায্যের আবেদন জানিয়ে পাঠানো একটি বার্তা পেয়েছিলেন।

দেহলভি জানান, কারবালার যুদ্ধে রিহাব দত্তের বাহিনীর যারা বেঁচে যান, তাদের কেউ কেউ সেখানেই রয়ে যান, কেউ আবার মাতৃভূমি ভারতে ফিরে আসেন। কারবালার যে অংশটিতে এই বীর ব্রাহ্মণরা বসতি করেছিলেন, সেটি পরিচিত ছিল ‘আদ-দায়ার-উল-হিন্দিয়া’ নামে।

গুলাম রসুল দেহলভির কথায়, দত্ত ও তার সাহসী সেনারা যখন কারবালায় পৌঁছলেন, ততক্ষণে ইমাম হোসাইন শহীদ হয়েছেন। ক্ষোভে-দু:খে ভারত থেকে যাওয়া ওই সৈন্যরা স্থির করলেন নিজেদের তরবারি দিয়েই তারা নিজেদের শিরশ্ছেদ করবেন। কিন্তু, ইমামের আরব অনুরাগীরা তাদের বোঝালেন, এভাবে জীবন নষ্ট না করে তারা যেন বরং জনাব-ই-মুখতারের বাহিনীতে যোগদান করুন এবং ইমামের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার লড়াইতে সামিল হন। রিহাব দত ও তার বাহিনী ঠিক সেটাই করেছিলেন; ইয়াজিদের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ করে প্রাণোৎসর্গ করেছিলেন।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বশেষ নিউজ