১৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৪শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

নেপথ্যের জার্ণাল ১৯৭১: সিলেট শহরে বুদ্ধিজীবীদের হ ত্যা

admin
প্রকাশিত ১৪ ডিসেম্বর, রবিবার, ২০২৫ ২০:৫০:৫৭
নেপথ্যের জার্ণাল ১৯৭১: সিলেট শহরে বুদ্ধিজীবীদের হ ত্যা

Manual5 Ad Code

সুনির্মল সেন: ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল, তৎকালীন সিলেট শহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর ধ্বংসলীলায় মানুষ যখন দিশেহারা। ওই সময় প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আর্ত মানুষের সেবায় নির্ভীক ছিলেন সিলেট সদর হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান শহীদ অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমদ। যুদ্ধের এমন পরিস্থিতির সময় তৎকালীন সিলেট শহরের একমাত্র সরকারি হাসপাতাল, বর্তমানে যেটা সদর হাসপাতাল কিংবা শহীদ ডা: শামসুদ্দিন হাসপাতাল নামে পরিচিত এখান ছেড়ে যাননি ডা:শামসুদ্দিন আহমদ। পরিস্থিতি লক্ষ্য করে তিনি নিজের পরিবার-পরিজনকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। এমনকি হাসপাতালের মহিলা চিকিৎসক আর সেবিকাদের ছুটি দিয়ে তিনি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য একটি মেডিক্যাল টিম গঠন করেন। তাকে সাহায্য করার জন্য হাসপাতালে থেকে যান আরও কয়েকজন। সে সময় মেডিক্যাল টিমের সদস্যরা ছিলেন-তরুণ শিক্ষানবিশ (ইন্টার্নি) চিকিৎসক ডা. শ্যামল কান্তি লালা, অপারেশন থিয়েটারের সেবক মাহমুদুর রহমান, অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার কোরবান আলীসহ আরও কয়েকজন। পরবর্তীতে পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিতে সঙ্গীদের নিয়ে শহীদ হন ডা. শামসুদ্দীন আহমদ। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল থেকে ৮ এপ্রিল সিলেট শহর মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে ছিলো। এসময় পাকিস্তানি হানাদাররা সিলেট শহর দখল করার জন্য অতিরিক্ত সেনা এনে ৭ ও ৮ এপ্রিল নৃশংস গণহত্যা চালায়। হত্যা করে সাধারণ মানুষসহ মুক্তিযোদ্ধাদের। এদিকে ৯ এপ্রিল পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধাদের হটিয়ে সিলেট শহর নিয়ন্ত্রণে নেয়। হাসপাতালের পূর্ব পাশে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ, সিভিল সার্জনের বাংলো আর টিলার নিচে সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায় পাকিস্তানিরা তাদের ক্যাম্প গড়ে তোলে। ওই দিন সকাল ৯টায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের সিভিল সার্জনের বাংলো আর আলিয়া মাদ্রাসা ক্যাম্পে হামলা চালায়। সে সময় পাকিস্তানি বাহিনীর তিন সেনা মারা যায়। এরপর বেপরোয়া হয়ে ওঠে পকিস্তানিরা। মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে পাকিস্তানিরা হাসপাতালে যায়। তাদের না পেয়ে ডা. শামসুদ্দিনসহ পাঁচজনকে লাইন করে দাঁড় করানো হয়। এরপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ব্রাশফায়ারে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ডা. শামসুদ্দিন আহমদ । এরপর একে একে হত্যা করা হয় শিক্ষানবিশ চিকিৎসক ডা. শ্যামল কান্তি লালা, অপারেশন থিয়েটারের সেবক মাহমুদুর রহমান, অ্যাম্বুলেন্স চালক কোরবান আলীসহ অফিসে কর্মরত আরও ৭/৮ জনকে। শহীদ অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমদ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি সিলেট মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিও নির্বাচিত হন। মর্মান্তিক,নৃশংস এমন ঘটনার কয়েকদিন পর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় সিলেট মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ও সুপারিনটেনডেন্ট লে. কর্নেল ডা. জিয়াউর রহমানকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। তাকে কোথায় নিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তা এখন পর্যন্ত কেউ জানে না। এমনকি তার লাশেরও খোঁজ শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। সে সময়ের ঘটনার ব্যপারে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাসপাতালে শহীদ অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমদের সঙ্গে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাসহ আহত মানুষদের চিকিৎসা সেবা দিতেন শিক্ষানবিশ ডা. শ্যামল কান্তি লালা। তাদের সহযোগী ছিলেন অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার কোরবান আলী। যিনি গুলির শব্দ শুনলেই ঝুঁকি নিয়ে রাজপথ থেকে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে আসতেন। সিলেট নগরের বুদ্ধিজীবী সমাধিস্থল প্রাঙ্গণে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রবিবার (১৪ ডিসেম্বর) শহীদদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর স্থানটি পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে। পরিষ্কার করা হচ্ছে বুদ্ধিজীবীদের সমাধিস্থল। বুদ্ধিজীবী সমাধিস্থলে গণকবরও রয়েছে। যেখানে মুক্তিযোদ্ধা, চিকিৎসক, আনসারসহ সাধারণ মানুষের লাশ রয়েছে। এখানে শহীদ অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমদ, শহীদ চিকিৎসক ডা. শ্যামল কান্তি লালা, অ্যাম্বুলেন্স চালক শহীদ কোরবান আলীর কবরও রয়েছে। বীরমুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীন নাট্যকর্মী ভবতোষ রায় বর্মণ জানান, ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী শুধু হাসপাতালেই হত্যাযজ্ঞ চালায়নি। তারা পুরো সিলেট নগর জুড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠক, শিল্পপতি, জমিদার, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, লেখকদের তালিকা তৈরি করে হত্যা করে গণহত্যা চালায়। বুদ্ধিজীবীদের সমাধিস্থলে মুক্তিযোদ্ধা, আনসার ও চিকিৎসকদের একটি গণকবর রয়েছে। পাকিস্তানিরা তাদেরকে হত্যা করে এখানে গর্ত খুঁড়ে পুঁতে রাখতো। (কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক)