
নিজস্ব প্রতিবেদক | ঢাকা
বিগত ফ্যাসিবাদী শাসনামলের নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতম ঘটনাগুলো এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ইতিহাস ফুটে উঠেছে ঢাকার মেট্রোরেলের পিলারজুড়ে। রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত মেট্রোরেলের স্তম্ভে এখন দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের এক রক্তাক্ত অতীতের শিল্পিত দলিল।
কারওয়ান বাজার স্টেশনের পিলার থেকে শুরু হয়ে ফার্মগেট পদচারী সেতু পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা এই গ্রাফিতিতে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া গুম, খুন, নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনাগুলো চিত্রিত হয়েছে। শিরোনাম দেওয়া হয়েছে— ‘ফিরে দেখা ফ্যাসিস্ট রেজিম’।
প্রত্যেকটি পিলারে একেক বছরের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক সহিংসতা ও দমন-পীড়নের ঘটনাগুলো স্থান পেয়েছে।
কারওয়ান বাজার অংশে শুরু হয়েছে ২০০৯ সালের পিলখানা হত্যাকাণ্ড দিয়ে। পরবর্তী পিলারগুলোতে দেখা যাচ্ছে নিমতলী অগ্নিকাণ্ড, খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল, ফেলানী হত্যা, শেয়ারবাজার ধস, সাগর-রুনি হত্যা, বিশ্বজিৎ দাস হত্যাসহ বহু ঘটনার চিত্র।
গ্রাফিতিতে আরও দেখা যায় ইলিয়াস আলীকে গুম, রানা প্লাজা ধস, শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ড, তনু ধর্ষণ, রামপাল আন্দোলন, নাসিরনগরে হামলা, হলি আর্টিজান হামলা, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, আবরার ফাহাদ হত্যা, মেজর সিনহা হত্যা, মুশতাক আহমেদ হত্যা, বাঁশখালী শ্রমিক হত্যা, কোভিড অব্যবস্থাপনা, জ্বালানি সংকট, ভিসা নিষেধাজ্ঞা, বাজারদর বৃদ্ধি, এবং সর্বশেষে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান ও ফ্যাসিবাদের পতন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন ড. আজহারুল ইসলাম শেখ বলেন,
“শিল্পকলা প্রতিবাদের একটি শক্তিশালী মাধ্যম। মেট্রোরেলের পিলারে যে গ্রাফিতিগুলো তৈরি হয়েছে, তা শুধু শিল্প নয়, এটি একধরনের সামাজিক প্রতিবাদও। ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁদের রঙের মাধ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।”
রাজধানীর ব্যস্ত পথচারীরাও প্রশংসা করছেন এই উদ্যোগের। কারওয়ান বাজারে চা খেতে খেতে বেসরকারি চাকরিজীবী আনিসুর রহমান বলেন,
“আইডিয়াটা দারুণ। হাঁটতে হাঁটতে যেন গত ১৬ বছরের ইতিহাস চোখের সামনে ভেসে ওঠে। শহরটা সুন্দরও লাগছে।”
এই অভিনব উদ্যোগের ধারণা দেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, আর বাস্তবায়ন করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। গত আগস্টে উদ্বোধনের সময় উপদেষ্টা বলেন,
“এই গ্রাফিতিগুলো আওয়ামী স্বৈরশাসনের ভয়াল দিনগুলো এবং জনগণের সাহসী প্রতিরোধের ইতিহাস বারবার আমাদের মনে করিয়ে দেবে। ভবিষ্যতে যেন আর কোনো স্বৈরাচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সে লক্ষ্যেই এই শিল্প উদ্যোগ।”
এছাড়া শাহবাগে জাতীয় জাদুঘর থেকে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (সাবেক পিজি হাসপাতাল) পর্যন্ত আঁকা হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদলের উদ্যোগে আরেকটি গ্রাফিতি সিরিজ।
এতে ফুটে উঠেছে ছাত্রদের এক দফা দাবি, কোটা সংস্কার আন্দোলন, ‘সবার আগে বাংলাদেশ’ স্লোগান, পুলিশি নির্যাতনের দৃশ্য, এবং চূড়ান্ত লড়াইয়ের দিনগুলোর চিত্র।
এই অংশটি শেষ হয়েছে পরীবাগে, যেখানে দেখা যায় রিকশাচালকের স্যালুট, আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা, এবং শহীদ গোলাম নাফিজের লাশ বহনের দৃশ্য।
গ্রাফিতির এই আন্দোলন শুধু ইতিহাস স্মরণ করায় না, বরং নতুন প্রজন্মকে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সচেতন করে তুলছে।
রঙের ভাষায় আঁকা এই চিত্রগুলো যেন বলে—
“অন্যায়ের দিন ফুরিয়েছে, ইতিহাস কথা বলছে।”