১৬ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১লা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৫শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

লাগামহীন ক্ষমতার পথে ট্রাম্পকে এগিয়ে দিল সুপ্রিম কোর্ট

admin
প্রকাশিত ২৮ জুন, শনিবার, ২০২৫ ২২:২০:৪৭
লাগামহীন ক্ষমতার পথে ট্রাম্পকে  এগিয়ে দিল সুপ্রিম কোর্ট

Manual5 Ad Code

যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের এক বিতর্কিত রায়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাহী ক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বিলুপ্ত হলো। জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বিষয়ে দেওয়া রায়টি ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য বড় জয়। শুধু তাই নয়, মার্কিন বিচারব্যবস্থা ও নির্বাহী শাখার ভারসাম্যে যুগান্তকারী পরিবর্তনের বার্তাও দিল এই রায়। ছয় রক্ষণশীল বিচারপতির সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দেওয়া রায়ে ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতের নিষেধাজ্ঞা জারির ক্ষমতা সীমিত করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস ও বিচারপতি অ্যামি কোনি ব্যারেটের এই রায়ের মাধ্যমে কার্যত লাগামহীন ক্ষমতার পথে ট্রাম্পকে একধাপ এগিয়ে দিল সর্বোচ্চ আদালত।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুর দিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রকাশ্যে তাঁকে ভর্ৎসনা করেছিলেন প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস। আর বিচারপতি অ্যামি কোনি ব্যারেট প্রশ্ন তুলেছিলেন, ট্রাম্প প্রশাসন আদৌ আদালতের আদেশ মানবে কি না। কিন্তু তাঁদের উদ্বেগ যে ক্ষণস্থায়ী, তা প্রমাণ করতে বড় ভূমিকা রাখলেন সর্বোচ্চ আদালতের দুই বিচারপতি। ব্যারেটকে দিয়ে গতকাল শুক্রবার রবার্টস এমন এক রায় লেখালনে, যা প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতার ওপর গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে দিল— হোক তা জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিলের উদ্যোগ বা ফেডারেল সরকার ও ব্যক্তি অধিকারের ওপর প্রভাব ফেলতে চাওয়া নীতির বাস্তবায়ন।

সুপ্রিম কোর্টের হোয়াইট মার্বল ভবনে নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে এই রায় হয়। ব্যারেটের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মত এবং বিচারপতি সোনিয়া সোটোমেয়রের ভিন্নমতের বক্তব্য— এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব আদালতের ভেতরেই প্রতিফলিত হয়। এই রায়ে আরও একটি প্রবণতা স্পষ্ট হয়— ছয় বিচারপতির রক্ষণশীল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের এজেন্ডার সঙ্গে একমত। এই সমর্থনের পেছনে রয়েছে অভিবাসী বহিষ্কার বা স্বাধীন সংস্থার প্রধানদের অপসারণের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতা বিচারপতিরাই বাড়াতে চান। এছাড়া দ্বিতীয় মেয়াদে যখন আদালত এলজিবিটিকিউ ও সামাজিক নীতি নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক তুলেছে, তখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিরা ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থানেই থেকেছেন।

গতকাল শুক্রবার ৬-৩ ভোটে মেরিল্যান্ডের একদল ধর্মীয় বিশ্বাসী অভিভাবকের পক্ষে রায় দেন বিচারপতিরা। তাঁরা চাইছিলেন, তাঁদের শিশুদের সরকারি বিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট কিছু এলজিবিটিকিউ সম্পর্কিত বই না পড়াতে। এর আগের সপ্তাহে এই ছয় বিচারপতিই ১৮ বছরের নিচে ট্রান্সজেন্ডার কিশোরদের জন্য জেন্ডার কেয়ার নিষিদ্ধ করার রাজ্যের আইন বহাল রাখেন।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সুপ্রিম কোর্টে প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মামলাতেই জয়ী হয়েছেন— হোক তা নিয়মিত শুনানির সময় বা জরুরি আপিলে। গতকাল জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিল সংক্রান্ত মামলার রায়ের পর হোয়াইট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি ব্যারেটকে অনেক সম্মান করি। সব সময় করেছি। আজকের রায়টি তিনি অসাধারণভাবে লিখেছেন—সবার কাছ থেকেই এমনটাই শুনছি।’ যদিও ব্যারেট জোরালোভাবে তাঁর অবস্থান সমর্থন করছেন না বলে এর আগে সমালোচনা করেছিলেন।

সুপ্রিম কোর্টের রায় ট্রাম্পের পক্ষে আসার প্রবণতা স্পষ্ট হলেও নিম্ন আদালতের বিচারকেরা তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুর দিকেই বহু নির্বাহী আদেশ ঠেকিয়ে দেন। কিছু বিচারক তাঁর ক্ষমতাকেন্দ্রিক পদক্ষেপ নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ওয়াশিংটন ডিসির ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের এক বিচারক রায়ে লেখেন, ‘একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রাজা নন।’

কিন্তু গতকালের রায় ও গত বছরের প্রেসিডেন্টের দায়মুক্তি সংক্রান্ত রায় মিলিয়ে এখন প্রেসিডেন্ট পদের ক্ষমতা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। বিচারপতি সোনিয়া সোটোমেয়র তাঁর ভিন্নমতের বক্তব্যে বলেন, ‘নির্বাহী দায়মুক্তির দ্বিতীয় ধাপও সম্পন্ন হলো।’

আদালত কক্ষে দ্বৈত অবস্থান

গতকাল সকাল ১০টায় সুপ্রিম কোর্টে এই মেয়াদের শেষ অধিবেশন যখন শুরু হয়, তখনও ছয়টি মামলার রায় বাকি ছিল। ট্রাম্প সংক্রান্ত মামলাটিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছিল। তাই ধরে নেওয়া হয়, এই রায়ের লেখক হবেন রবার্টস বা অন্য কোনো জ্যেষ্ঠ বিচারপতি। আর তা হলে রায়টি শুনানির একেবারে শেষে আসবে, কারণ বিচারপতিরা সিনিয়রিটির উল্টোক্রমে রায় পাঠ করেন। কিন্তু এই ধারণা ভেঙে দিয়ে রবার্টস শুরুতেই জানান, ট্রাম্প বনাম সিএএসএ মামলার রায় লিখেছেন বিচারপতি ব্যারেট।

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে মনোনীত বিচারপতি ব্যারেট রক্ষণশীল অংশের সবচেয়ে কণিষ্ঠ সদস্য। এত গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় লেখার দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া সচরাচর হয় না। তাই এটিকে ব্যারেটের ওপর রবার্টসের আস্থার প্রকাশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। আবার মাঝেমধ্যে মধ্যপন্থা নেওয়া বিচারপতির সঙ্গে রবার্টসের সুসম্পর্ক গড়ার কৌশলও হতে পারে এটা। গতকালের রায়ে ব্যারেটের সঙ্গে একমত ছিলেন— বিচারপতি থমাস, আলিতো, গরসাচ, কাভানো ও রবার্টস।

ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার দিন ২০ জানুয়ারি বিতর্কের সূচনা হয়েছিল। ওই দিন তিনি জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের প্রচলিত ব্যাখ্যা বাতিল করে নতুন আদেশ দেন—যাতে বলা হয়, যেসব শিশুদের জন্ম হয় এমন অভিভাবকের পরিবারে যারা যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বা সাময়িক ভিসায় (যেমন ট্যুরিস্ট বা স্টুডেন্ট) অবস্থান করছেন, তাদের নাগরিকত্ব থাকবে না।

প্রথম দৃষ্টিতে এটিকে ‘অসাংবিধানিক’ বিবেচনা করে নিম্ন আদালতের একাধিক বিচারক ওই আদেশে অন্তর্বর্তী নিষেধাজ্ঞা দেন। পরে হোয়াইট হাউস প্রশাসন সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। তবে সুপ্রিম কোর্ট পুরো আদেশের সাংবিধানিকতা নিয়ে রায় দিক— এটা তাঁরা চায়নি। বরং তারা চেয়েছিল, নিম্ন আদালতের বিচারকেরা ট্রাম্পের নীতির ওপর দেশজুড়ে কার্যকর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেন কি না— তা নির্ধারণ করুক সর্বোচ্চ আদালত।

নিম্ন আদালতের বিচারকেরা এমন ‘বিশ্বজনীন নিষেধাজ্ঞা’ দিয়ে প্রেসিডেন্টের নীতিগুলো কার্যকর হওয়া থেকে বিরত রেখেছেন। চূড়ান্তভাবে বৈধ কি অবৈধ, সে বিষয়ে রায়ের অপেক্ষায় রয়েছেন তাঁরা। ব্যারেট বলেন, যারা জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব নিয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের এখতিয়ার ছাড়িয়ে গেছেন।

Manual4 Ad Code

১৭৮৯ সালের আইন অনুসারে আদালতের ক্ষমতা নির্ধারণ করে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্টের কর্মকাণ্ড নিয়ে আদালতের ভূমিকা ‘নমনীয়, তবে সীমাহীন নয়।’

তিনি আরও লেখেন, ‘অনেকে বলেন, এই নিষেধাজ্ঞা নির্বাহী শাখার ওপর বিচার বিভাগের ক্ষমতা প্রয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। কিন্তু ফেডারেল আদালতের কাজ হলো কেবল নির্দিষ্ট মামলা ও বিরোধ নিষ্পত্তি করা, নির্বাহী শাখার ওপর সার্বিক নজরদারি নয়।’

ব্যারেট যখন শান্ত গলায় রায় পড়ছিলেন, তখন তাঁর সহবিচারকেরা নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ব্যারেটের পাঠ শেষ হতেই বিচারপতি সোটোমেয়র প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে তাঁর প্রতিবাদ জানান। সাধারণত ভিন্নমত থাকলে বিচারপতিরা শুধু লিখিত বক্তব্যেই মত দেন। কিন্তু যেসব রায়ে তাঁরা তীব্র আপত্তি করেন, তখন তাঁরা তা আদালত কক্ষে পড়ে শোনান। গতকাল সোটোমেয়র ঠিক সেটাই করেন। নি তাঁর চেয়ারে এগিয়ে বসে ২০ মিনিট ধরে বক্তব্য দেন—ব্যারেটের চেয়ে দ্বিগুণ সময়।

সোটোমেয়র বলেন, এই রায় আদালতের ক্ষমতাকেই ক্ষুণ্ন করে। ১৮৫৭ সালের ড্রেড স্কট বনাম স্যান্ড ফোর্ড মামলার কথা তুলে ধরেন তিনি। সেখানে বলা হয়, কৃষ্ণাঙ্গরা মার্কিন নাগরিক নয়। পরে ১৮৬৮ সালে পাস হওয়া চতুর্দশ সংশোধনী তা সংশোধন করে। সংশোধনীতে বলা হয়, ‘যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করলে বা প্রাকৃতিকভাবে নাগরিকত্ব অর্জন করলে এবং এখানকার বিচারব্যবস্থার আওতায় থাকলে, যে কেউ যুক্তরাষ্ট্র ও তাঁর রাজ্যের নাগরিক।’ সোটোমেয়র বলেন, ‘এই নতুন আইনি কাঠামোতে কোনো অধিকারই আর সুরক্ষিত নয়।’

Manual7 Ad Code

রক্ষণশীল সংখ্যাগরিষ্ঠের নিয়ন্ত্রণ

এই মেয়াদে সামাজিক নীতি, অভিবাসন ও নির্বাহী ক্ষমতা নিয়ে যত বড় মামলা হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোতেই তিনজন উদারপন্থী বিচারক— সোটোমেয়র, এলিনা কাগান ও কেটানজি ব্রাউন জ্যাকসন— প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের মতামত সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে খুব একটা প্রভাব ফেলেনি।

Manual1 Ad Code

গত সপ্তাহেও ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষে রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। তাতে কিছু অভিবাসীকে নিজ দেশের বদলে দক্ষিণ সুদানের মতো জায়গায় পাঠানো নিয়ে আদালতের বাধা সরিয়ে নেওয়া হয়।

সোটোমেয়র লিখেছেন, ‘এই আদালত শুধু চোখ বন্ধ করে রেখেছে— এটাই প্রথম না, ভবিষ্যতেও এমনটা হবে বলে আমি শঙ্কিত। সর্বোচ্চ আদালত যখন বারবার আইন লঙ্ঘনকে পুরস্কৃত করে, তখন বিচারব্যবস্থা ও আইনের শাসনের ওপর মানুষ আস্থা হারায়।’

ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির ব্যাপারে শুরুর দিকে কিছু রক্ষণশীল বিচারপতি সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু পরে তা কেটে যায়। গত ১৫ মে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব নিয়ে মৌখিক শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী ডি. জন সাওয়ারকে ব্যারেট জিজ্ঞাসা করেন, প্রশাসন কি সব আদালতের আদেশ মানবে?সাওয়ার বলেন, ‘সব সময় তা প্রযোজ্য নয়।’ ব্যারেট বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘তাই নাকি?’ এরপর তিনি প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কি সুপ্রিম কোর্টের রায়কে সম্পূর্ণভাবে মানবেন?’ সাওয়ার বলেন, ‘হ্যাঁ, সেটাই সঠিক।’

Manual3 Ad Code

রবার্টস অতীতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কিছুটা কঠোর মনোভাব দেখালেও এখন তিনি প্রশাসনের অবস্থানকেই সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করছেন। চলতি বছরের মার্চে ট্রাম্প এক বিচারককে ‘ইমপিচ’ বা অভিশংসনের দাবি জানানোর পর বিবৃতিতে রবার্টস বলেন, ‘এটা দুশো বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত যে কারও রায়ের সঙ্গে দ্বিমত থাকলেই তাকে ইমপিচ করা যায় না। সে জন্য আপিল প্রক্রিয়া রয়েছে।’ তবে সেটা তিন মাস আগের কথা। এর মধ্যে আরও অনেক রায় হয়েছে।

ট্রাম্পের বড় জয়

শুক্রবারের রায়ের পর সুপ্রিম কোর্টের ৬-৩ রক্ষণশীল সংখ্যাগরিষ্ঠতা ট্রাম্পের একক পক্ষে চলে গেছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি বিচারপতি ব্যারেটকে ধন্যবাদ জানাতে চাই—তিনি অসাধারণ রায় লিখেছেন। এছাড়াও বিচারপতি রবার্টস, আলিতো, গরসাচ, কাভানো এবং থমাস— এরা সবাই চমৎকার মানুষ।’

সুপ্রিম কোর্টের বার্তা স্পষ্ট— প্রেসিডেন্ট ও বিচারব্যবস্থার ভারসাম্য এখন বড় পরিবর্তনের মুখে। আর সেটা অনেকটাই হোয়াইট হাউসের দিকে হেলে গেছে।