বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের টিলা, পাহাড়, চা-বাগান আর আধ্যাত্মিকতার শহর সিলেট। এই শহরের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা শাহি ঈদগাহ, যা শুধু ঈদের নামাজের স্থান নয়—এটি তিন শতাধিক বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা এক জীবন্ত ইতিহাস, স্থাপত্যশিল্পের অনন্য নিদর্শন এবং আধ্যাত্মিক-রাজনৈতিক ঐতিহ্যের প্রতীক।
মোগল স্থাপত্যের নান্দনিক ছোঁয়া
সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে সিলেটের ফৌজদার মোহাম্মদ ফরহাদ খাঁর তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয় শাহি ঈদগাহ। টিলার ওপর রাজকীয় শৈলীতে নির্মিত এই স্থাপনা মোগল স্থাপত্যের বিশুদ্ধ রূপ ধারণ করে।
-
মূল ঈদগাহে উঠতে রয়েছে ২২টি অলংকৃত সিঁড়ি
-
প্রাঙ্গণজুড়ে ১৫টি গম্বুজ, সামনে আরও ৮টি গম্বুজ
-
চারদিকে ১০টি ফটক, সামনে তিনটি প্রধান গেট
-
অজুর জন্য পাকাঘাটঘেরা পুকুর ও চারপাশে সবুজ বৃক্ষের সমারোহ
প্রতি ঈদে লাখো মুসল্লির সমাগমে এই প্রাঙ্গণ হয়ে ওঠে সিলেটের বৃহত্তম ধর্মীয় মিলনমঞ্চ।
ঐতিহাসিক সংগ্রামের সাক্ষী
শাহি ঈদগাহ শুধু ইবাদতের স্থানেই সীমাবদ্ধ ছিল না—এটি একসময় ছিল আন্দোলনের সূতিকাগার।
-
১৭৭২ সালে এখান থেকেই সৈয়দ হাদী ও মাহদীর নেতৃত্বে শুরু হয় ব্রিটিশবিরোধী প্রথম আন্দোলন
-
পরবর্তী সময়ে এই ময়দান হয়ে ওঠে উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র
-
মহাত্মা গান্ধী, কায়েদে আজম জিন্নাহ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মো. আলী জওহর, সোহরাওয়ার্দীসহ বহু ঐতিহাসিক নেতা এখানে ভাষণ দিয়েছেন
ধর্ম, রাজনীতি, সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের মিলনস্থল হিসেবে শাহি ঈদগাহ সময়ের প্রবাহে এক বিশেষ মর্যাদা অর্জন করেছে।
নবরূপে সজ্জিত শাহি ঈদগাহ
সময়ের সঙ্গে এই ঐতিহ্যবাহী স্থাপনারও হয়েছে উন্নয়ন-সংস্কার।
-
২০০১ সালে সমাজসেবক জহির উদ্দিন তারু মিয়ার উদ্যোগে তিনটি প্রধান গেট সংস্কার
-
২০০৩ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান পুকুরঘাট নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন
-
২০১০ সালে বিদ্যুতায়ন ও ফুটপাত নির্মাণ
-
সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে প্রাচীর, সড়ক ও সবুজায়ন নির্মাণ
নতুন রূপে সাজলেও কাঠামোর মোগল সৌন্দর্য অক্ষুণ্ণ রয়েছে এখনো।
ঐতিহ্য, ধর্ম ও নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মিলন
অতীতের স্থাপত্য, বর্তমানের সংস্কার আর প্রকৃতির নীরব মাধুর্যে শাহি ঈদগাহ আজ সিলেটের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। প্রতিদিনই দেশ-বিদেশের পর্যটকরা আসেন—কেউ ইতিহাসের সন্ধানে, কেউ মোগল স্থাপত্যের নন্দিত রূপ দেখতে।
শাহি ঈদগাহ তাই শুধু একটি ঈদ মাঠ নয়; এটি সিলেটের আত্মার প্রতীক—ধর্ম, ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও সৌন্দর্যের এক অমলিন স্মারক।