‘সিলেটের বারুদ’র আহবান
সুনির্মল সেন ✍️
বাংলাদেশে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে গণমাধ্যম — ‘প্রিন্ট মিডিয়া’ এবং ‘অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘ এর সংখ্যা অবশ্যই বৃদ্ধি পেয়েছে। সারাদেশে কয়েক হাজার অনলাইন নিউজ পোর্টাল সক্রিয় থাকা সত্বেও নতুন একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল বুধবার (১ মে ২০২৪) আধ্যাত্নিত রাজধানী খ্যাত সিলেট থেকে আত্মপ্রকাশকে আমি স্বাগত জানাই। নিউজ পোর্টালটির (পত্রিকা ) নাম আমার কাছে বিশেষ অর্থবহ বহন করছে। সিলেটে যেহেতু জন্ম।তাই নামের প্রতি যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদর্শন করার জন্য এই অনলাইন পত্রিকাকে দেশ–জাতি–মুক্তিযুদ্ধ-অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনসহ বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে হবে।
বিভিন্ন আদর্শ এবং বিভিন্ন প্রভাব বলয়ের প্রতিভু হিসেবে অনেক পত্র -পত্রিকার নাম শুনতে পাই। এখান থেকে সর্বপ্রকার বহির্প্রভাব মুক্ত হয়ে এবং একমাত্র বাংলা মায়ের এবং বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের প্রভাবযুক্ত হয়ে এই পত্রিকা দৃপ্ত পদক্ষেপে যদি এগিয়ে যেতে পারে তবে পাঠক শ্রেণির জন্য এটা হবে যথার্থ পাওনা। বিভিন্ন মতাদর্শের প্রচার বিরামহীন প্রচার আমাদেরকে অতিষ্ঠ করে চলেছে। তারা আমাদেরকে বিভিন্ন দিকে আহবান করছে।
এবার –” সিলেটের বারুদ” এর আহবান কেমন হবে, আমরা শুনতে চাই।
মানব সৃষ্টির শুরু থেকেই কোনো না কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এমন প্রবল ছিলো যে, তাদের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে যে কোনো প্রতিবাদ করলে প্রাণ দিয়ে তার খেসারত দিতে হতো। অবশ্য ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হতে থাকে। ব্যক্তি বা মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী -স্বার্থেের বিরুদ্ধে জনমত প্রবল হতে হতে বর্তমানে এমন একটা পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে সত্য কথা আগের চেয়ে খোলাখুলিভাবে বলা যায়। শক্তিমানরাও এখন আর প্রকাশ্যভাবে তাদের দম্ভ প্রকাশ করে না। তবে তারা যে চুপ করে থাকে এমনো নয়।
অষ্টাদশ এবং উনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপীয়রা যেমন করে আফ্রো-এশিয়ান দেশসমূহে জোর করে উপনিবেশ স্থাপন করতো বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে এটা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু প্রভাবশালী দেশসমূহ সামরিক শক্তির ভয় দেখিয়ে এবং পুঁজির মাধ্যমে দুর্বল দেশে তাদের আধিপত্য এখনো বজায় রেখে চলেছে। প্রচার মাধ্যম তথা সংবাদপত্র এবং রেডিও –টেলিভিশন হচ্ছে তাদের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।
সত্যকথা বলতে কি, আর্থিক সঙ্গতি না থাকলে কেউ সত্য কথা প্রকাশ্যে বলতে পারে না।
স্ত্রী–সন্তানদের অভুক্ত রেখে সত্য কথা বলার সাহস কয়জনের বা থাকে! আমাদের দুর্ভাগ্য এখানে যে, আমরা গরীব। ধরা যাক, আর্থিক নিরাপত্তার অভাবে আমরা সত্য বলতে সঙ্কুচিত। মনি-কান্চনের লোভে কি আমাদের অসত্য বলতে হবে? সেটাতো আরো গর্হিত। আমার ভয়, আমরা এ পথে পা না বাড়াই।
লক্ষী আর সরস্বতী নাকি একই ব্যক্তিকে ভর করে না। সরস্বতীর বরপুত্ররা লক্ষীর আশীর্বাদ না পাওয়ার কথা। পুরষ্কার কবিতার কবি রাজাকে মুগ্ধ করে রাজভান্ডার ঘরে না এনে রাজার গলার ফুলের মালা নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে যুগ পাল্টে গেছে। আমরা একই সঙ্গে সরস্বতী এবং লক্ষীর আশীর্বাদ পেতে চাই, শেষেরটা পেছনের দরজা দিয়ে হলেও। আমাদের বর্তমান সমাজের অসঙ্গতি এখানেই।
ষাটের দশকে ‘পাকিস্তান টাইমস’ পত্রিকার একজন কলাম লেখক তার লেখায় বাঙালিদের বিরুদ্ধে আপত্তিজনক মন্তব্য করতেন। আমরা নীরবে তার হীনচিন্তা ও নোংরা আক্রমণের জ্বালা সহ্য করতাম। পরে এই কলাম লেখক পাকিস্তানের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ জুলফিকার আলী ভুট্রোর পেছনে লাগলো। ১৯৭০ সালে জুলফিকার আলী ভুট্রো প্রধানমন্ত্রী হয়ে ক্ষমতায় এসে প্রকাশ করে দিলেন যে, আইয়ুব খানের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পেতেন এই কলাম লেখক। দীর্ঘদিন ধরে যারা সাংবাদিকতা ও লেখা-লেখির সাথে সংশ্লিষ্ট তারা এর শুভ -অশুভ দিক সম্বন্ধে অবগত আছেন।
যারা এ পথের নতুন যাত্রী তাদের কাছে আমার বিনীতভাবে আবেদন, তারা যেন সর্বপ্রকার প্রলোভনের উর্ধ্বে থেকে সাংবাদিকতার মতো মহান পেশার গৌরবময় ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখেন। নতুবা উল্লেখিত মন্ত্র যদি গ্রহণ না করেন, এমনও দিন আগামীতে আসবে, সাধারণ নাগরিকেরা সাংবাদিকদের পিঠের চামড়া পিঠিয়ে তুলে নেবে। তখন করার কিছু থাকবে না। সিলেটে সাংবাদিকদের যে দৈন্যদশা তাই কথাটি সকলের উদ্দেশ্য তুলে ধরলাম।
জীবনে আদর্শের অনুসারী হয়ে সৎজীবন যাপনে অনেক কষ্ট। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি শুধু সাদামাঠা জীবনযাপনই নয়, এমন কি অর্থনৈতিকভাবে চরম দুর্গতিও। তবে সৌভাগ্যের বিষয় হলো– সত্যকে তুলে ধরতে যারা সংগ্রাম করে, সমাজকে এবং মানবতাকে যারা এগিয়ে নিয়ে যেতে সচেষ্ট থাকে তাদেরকে সমাজ-রাষ্ট্র– বিশ্বের নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অবশ্যই শ্রদ্ধার চোখে দেখে।
সম্ভবত ১৯৯৯ সালের মার্চ মাসে হবে।এক সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য এখানে উদ্ধৃত করা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি:
এখনো আমরা দেখি কেউ যদি সৎপথে চলে লোকে তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। হয়তো বা তার জামা কাপড়ে, সাজ-পোশাকে চাকচিক্য নেই। বড় বড় গাড়ি-বাড়ি হাঁকায় না, কিন্তু লোকে তাকে সমীহ করে, সম্মান দেয়। এটাইতো মৌলিকত্বের স্বীকৃতি, এটাই তো বড় পাওনা। অসৎ উপায়ে অর্জিত অর্থ দ্বারা চাকচিক্য, ঠাটবাট –সামনে লোকে বাহবা দেবে, গালভরা প্রশংসা করবে কিন্তু পেছনে ফিরে গালি দেবে। (বিচিত্রা, ১ম বর্ষ, ১৬ সংখ্যা, পৃষ্ঠা ২৬) নতুন প্রজন্মের যারা সাংবাদিকতা এবং লেখালেখিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন উপরোক্ত কথাগুলো তাদের অন্তরে গেঁথে রাখতে অনুরোধ করি। তাদের আদর্শ :
Laugh and be merry, better the world with a song.
Better the world with a blow in the teeth of a wrong.
(লেখক: কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক সুনির্মল সেন )