সুদানের বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) পক্ষে লড়াই করার জন্য কলম্বিয়ার ভাড়াটে সৈনিক নিয়োগের সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এই যোদ্ধা সরবরাহে বহুল আলোচিত সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) সম্পৃক্ততার বিষয়টি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় উল্লেখ করা হয়নি।
লন্ডনভিত্তিক মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ চার ব্যক্তি ও চারটি সংস্থার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কলম্বিয়ার সাবেক সামরিক সদস্যদের নিয়োগের সঙ্গে জড়িত একটি ‘আন্তঃদেশীয় নেটওয়ার্কের’ অংশ বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
মার্কিন ট্রেজারি বিভাগের বিবৃতিতে বলা হয়, কলম্বিয়ার এসব যোদ্ধা আরএসএফকে কৌশলগত ও কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং ইনফ্যান্ট্রি ও আর্টিলারিম্যান, ড্রোন পাইলট, চালক ও প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেছে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে শিশুদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। খার্তুম, ওমদুরমান, করদোফান ও এল-ফাশেরসহ সুদানের বিভিন্ন যুদ্ধে তারা অংশ নিয়েছে বলে জানানো হয়।
অক্টোবরে এল-ফাশেরে আরএসএফের ঝটিকা আক্রমণের সময় ব্যাপক গণহত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনার কিছু আরএসএফ যোদ্ধাদের নিজেরাই নথিভুক্ত করেছে এবং স্যাটেলাইট চিত্রের মাধ্যমে তার সত্যতা নিশ্চিত হয়েছে। ট্রেজারি বিভাগ জানায়, কলম্বিয়ার যোদ্ধাদের সুদানে উপস্থিতি বহু ব্যক্তি ও সংস্থার সহায়তা ছাড়া সম্ভব হতো না, যাদের অধিকাংশই কলম্বিয়ার নাগরিক।
নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে বোগোতাভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিসেস এজেন্সি। প্রতিষ্ঠানটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা, সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থানরত কলম্বিয়ার সাবেক সেনা কর্মকর্তা আলভারো আন্দ্রেস কুইজানো বেসেরা এবং তাঁর স্ত্রী ক্লদিয়া ভিভিয়ানা অলিভারোস ফোরো—যিনি প্রতিষ্ঠানটির মালিক ও ব্যবস্থাপক—এদের বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
কলম্বিয়ার সংবাদমাধ্যম লা সিয়া ভেসিয়া-এর ফাঁস করা নথি অনুযায়ী, ইউএইতে নিবন্ধিত একটি কোম্পানি সুদানে কাজের জন্য শত শত সাবেক কলম্বিয়ান সৈনিক সরবরাহের বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিসেস এজেন্সির সঙ্গে চুক্তি করেছিল। ওই আমিরাতি কোম্পানি গ্লোবাল সিকিউরিটি সার্ভিসেস গ্রুপ নিজেদেরকে ‘ইউএই সরকারের একমাত্র সশস্ত্র বেসরকারি নিরাপত্তা পরিষেবা প্রদানকারী’ হিসেবে দাবি করে। তবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ঘোষণায় এই প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
তদন্তকারী সংস্থা দ্য সেন্ট্রি গত মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানায়, কলম্বিয়ার ভাড়াটে সৈনিক সরবরাহকারী আমিরাতি ব্যবসায়ীরা ইউএইয়ের উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যুক্ত। তবুও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় এ বিষয়ে কোনো সরাসরি উল্লেখ নেই।
নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত অন্য সংস্থাগুলো হলো—পানামাভিত্তিক গ্লোবাল স্টাফিং এসএ, কলম্বিয়াভিত্তিক মেইন গ্লোবাল কর্প এসএএস এবং কমার্সিয়ালাইজাদোরা সান বেনিটো। একই সঙ্গে কলম্বিয়ার নাগরিক মনিকা মুনিওজ উক্রোস এবং কলম্বিয়ান-স্প্যানিশ দ্বৈত নাগরিক মাতেও আন্দ্রেস ডুকে বোতেরোর বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
ট্রেজারি বিভাগ জানায়, নিষেধাজ্ঞার ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের যুক্তরাষ্ট্রে থাকা বা মার্কিন নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণাধীন সব সম্পদ অবরুদ্ধ করা হয়েছে এবং সেগুলোর তথ্য সরকারকে জানাতে হবে।
এর আগে সেপ্টেম্বর মাসে, আরএসএফের পক্ষে কলম্বিয়ার ভাড়াটে সৈনিকদের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগে ইউএইয়ের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ তোলে সুদান। জাতিসংঘে সুদানের প্রতিনিধি দাবি করেন, আটক যোদ্ধাদের কাছ থেকে পাওয়া নথিতে দেখা গেছে যে ইউএইয়ের দুটি বেসরকারি নিরাপত্তা কোম্পানি এই ভাড়াটে সৈনিকদের নিয়োগে যুক্ত। তবে ইউএই এসব অভিযোগকে ‘মনগড়া’ বলে প্রত্যাখ্যান করে।
গত ৭ আগস্ট সুদানের বিমান বাহিনী ইউএইয়ের বলে সন্দেহ করা একটি বিমান ভূপাতিত করে। বিমানটিতে কলম্বিয়ার ৪০ জন ভাড়াটে সৈনিক এবং আরএসএফের জন্য অস্ত্র ও সরঞ্জাম ছিল বলে দাবি করা হয়। ওই ঘটনায় বিমানটিতে থাকা সবাই নিহত হন। ইউএই এ ঘটনায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে গেরিলা ও মাদকচক্রবিরোধী যুদ্ধে অংশ নেওয়ার কারণে কলম্বিয়ার সাবেক সেনারা আধুনিক অনিয়মিত যুদ্ধে অত্যন্ত চাহিদাসম্পন্ন। ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শন ম্যাকফেট বলেন, কলম্বিয়ান সৈন্যরা অত্যন্ত অভিজ্ঞ, শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং তুলনামূলকভাবে কম খরচে পাওয়া যায়।
২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া সুদানের গৃহযুদ্ধে ইতোমধ্যে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে এবং এক কোটিরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এই যুদ্ধে আরএসএফ ও সুদান সেনা—উভয় পক্ষের বিরুদ্ধেই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উঠেছে।